বিচার বিভাগকে যেন রাজনীতিকরণ করা না হয় : প্রধান বিচারপতি

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান । ছবি: সংগৃহীত

সারাবিশ্বডটকম নিউজ ডেস্ক: প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, ‘আমি চাইব বিচার বিভাগ ও বিচারালয়কে যেন কোনোভাবে রাজনীতিকরণ করা না হয়। এখানে বিচারক ও বিজ্ঞ আইনজীবীদের সম্মিলিত ও মেধাপুষ্ট দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই কেবল সুবিচারের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। এই বিচার অঙ্গণ পারস্পরিক সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসায় আলোকিত হোক, এটিই আমার প্রত্যাশা’।

আজ রবিবার সুপ্রিম কোর্ট বার ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। আপিল বিভাগের এক নম্বর এজলাস কক্ষে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়। এসময় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, প্রধান বিচারপতির পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। তবে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা অনুষ্ঠান বর্জন করে আদালতের বাইরে ইউনাইটেড ল’ ইয়ার্স ফ্রন্টের ব্যানারে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো বিষয়ে ভালোভাবে না জেনে বা যথেচ্ছভাবে বিচারক ও আদালত সম্পর্কে কটূ মন্তব্য মোটেই সভ্যতার ইঙ্গিত বহন করে না। কোনো বিচারকই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সভ্য জগতে ভব্য সমালোচনার একটা অবকাশ রয়েছে। বিচারকের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার বাকস্বাধীনতার এক অংশ বলে আমি মনে করি। আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানে এই বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। তবে কেউ যদি স্বাধীনতার অপব্যবহার করে তা সংবাদ মাধ্যমই হোক, আইনজীবীই হোক বা যে কেউ হোক তাকে শায়েস্তা করার জন্য আদালতের হাত যথেষ্টই লম্বা’। 

নবীন আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একাগ্রতা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম পেশার সবচেয়ে বড় মূলধন। নবীন আইনজীবীদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। অর্থ উপার্জনের প্রতি মোহ অনেক সময় তরুণ আইনজীবীদের বিভ্রান্ত ও অনৈতিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। নতুন আইনজীবীদের অর্থকড়ির এই সহজ মোহ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। তাদের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে, সততার সঙ্গে লিগ্যাল প্র্যাকটিসে লেগে থাকলে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিতভাবে আসবে। এই পেশায় শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই’। 

নিম্ন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অসহায় মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ যেন নিশ্চিত হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব পালনের প্রকৃতি ও বিশালতায় আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও বিচারক হিসেবে আমাদের কারও মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সকলেই বিচারক’।

‘অধস্তন আদালতসমূহকে আমি বিচার বিভাগের ‘প্রেস্টিজ পয়েন্ট’ বলে মনে করি। সম্মিলিতভাবে বিচারক হিসেবে আমাদের সকলের সুনাম সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে অধস্তন আদালতের ওপর। কেননা, প্রাত্যহিক কাজে সবচেয়ে প্রান্তিক জায়গা থেকে একজন বিচারপ্রার্থী শুরুতেই যে আদালতের দারস্থ হন সেটি হলো জেলা পর্যায়ের কোনো আদালত। তাই জেলা পর্যায়ের আদালতসমূহে আমার যে সহকর্মী বিচারকবৃন্দ কর্মরত আছেন তাদের বলব, তারা যেন কখনোই সময়ের অপচয় না করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগাস্তি লাঘবে কাজ করেন’।

তিনি আরও বলেন, ‘বারের বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দ, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ ও বিচারপ্রার্থী জনগণের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, বিচারকের চরিত্রের সঙ্গে অহেতুক তাড়াহুড়া, হঠাৎ ধৈর্য হারানো, আইনজীবীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, আদেশ ও রায় লেখার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি আচরণ কখনোই যায় না। তাই সচেতনভাবে এসব পরিহার করে চলতে হবে। অধস্তন আদালতের বিচারকবৃন্দের অসুবিধাসমূহও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে বারের বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্যদের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন বিজ্ঞ বিচারকদের দায়িত্বপালনের প্রতি সবসময় সহায়তামূলক সাহায্যের মনোভাব অক্ষুণ্ন রাখেন’। 

দুর্নীতির প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মানব সমাজ ও বিচারপ্রার্থীর কল্যাণে এবং দ্রুত ও দুর্নীতিমুক্ত সুবিচার নিশ্চিতকরণে নিবেদিত হওয়ার মাধ্যমে মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি একজন বিচারক বা আইনজীবীর ভালোবাসা মূর্ত হতে পারে। আর এর মাঝেই আমরা পেতে পারি আমাদের কর্মজীবনের সার্থকতা। সংবিধানের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিচার প্রশাসনকে রাখতে হবে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, স্বাধীন এবং সোশ্যাল জাস্টিস তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি দুর্নীতিমুক্ত বিচারব্যবস্থা দেশ ও জাতির জন্য গর্বের। আমার দায়িত্ব পালনকালে আমার সতীর্থ বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ এবং আপনারা বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দের সুচিন্তিত পথ ধরে একটি দুর্নীতিমুক্ত বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব’। 

সাক্ষী সুরক্ষা আইন নিয়ে তিনি বলেন,‘ সাক্ষী ও ভিকটিমদের সুরক্ষার জন্য দেশে এখন পর্যন্ত কোনো আইন প্রণীত হয়নি। স্থানীয় প্রভাব ও ভীতিতে আক্রান্ত সাক্ষীরা সমন জারি সত্ত্বেও আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসে না। আসলেও ভয়ে সাক্ষীরা আদালতে সত্য গোপন করে। ফলে মামলার বিচার প্রলম্বিত হয়। অনেক সময়েই সাক্ষীর হাজিরা নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কলম কার্যকরভাবে সচল হয় না। বছরের পর বছর প্রলম্বিত হয় বিচার। সাক্ষীরা হয়ে পড়ে অনাগ্রহী। এসব অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। এজন্য সকলের সক্রিয় ভূমিকা অনিবার্য’।

আইনের শাসন প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যে সমাজে আইনের শাসন যতটা দৃঢ় সেই সমাজ ও রাষ্ট্র তত বেশি সভ্য ও মানবিক। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুণগত মান উন্নয়নে বিচারবিভাগের রয়েছে অপরিহার্য ভূমিকা। বিচারকের কর্তব্য ও আচরণ সম্পর্কে যে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ধারণা আমরা দেখি তা সব সভ্য সমাজে ও রাষ্ট্রে অভিন্ন ও ধ্রুব হিসেবেই বিরাজমান রয়েছে’।

সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘বিচারকগণ সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে কোনো বক্তব্য প্রদান করতে পারেন না। তাই সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আদালত বা বিচারক সম্পর্কিত কোনো সংবাদ পরিবেশনে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবেন’।