সারাবিশ্বডটকম অনলাইন নিউজ ডেস্ক: এখন কেবল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। বাকি আর মাত্র ২৯ দিন। তারপরই খুলে যাবে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু। দক্ষিণের সঙ্গে সেতুবন্ধন হবে উত্তরের। সড়কপথে বরিশাল থেকে তিন ঘণ্টায় যাওয়া যাবে ঢাকা। বদলে যাবে পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে থাকা ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য। উন্নয়নের মহাসড়কে নাম লেখানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে অবহেলিত বরিশাল-খুলনার জনপদ। তাইতো এখন আনন্দের জোয়ার বইছে দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে। রাজনৈতিক অবস্থান আর দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রায় সবাই-ই খুশি পদ্মা সেতুর সাফল্যে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নেওয়া এই সেতু পার হওয়ার।
সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার যানবাহন চলাচলের জন্য পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার সময় জানিয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৫ জুন সকালে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপরই তা খুলে দেওয়া হবে যানবাহন চলাচলের জন্য। এ ঘোষণার পরপরই আনন্দের ঢেউ বয়ে যায় বরিশাল-খুলনাসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে। এ যেন শত বছরের প্রতীক্ষা পূরণ হওয়ার দিন।
একটা সময় ছিল পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা থেকে সড়ক পথে রাজধানী ঢাকায় যেতে পার হতে হতো ১৫টি ফেরি। বরিশাল থেকে ঢাকা পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৯। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময়ে একের পর এক সেতু নির্মাণে এখন কেবল পদ্মা ছাড়া আর কোনো ফেরি নেই ঢাকা-কুয়াকাটা পর্যন্ত ২৮২ কিলোমিটার সড়কে। কুয়াকাটার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কুয়াকাটা থেকে সড়কপথে ঢাকা যাওয়াটা একসময় স্বপ্ন ছিল আমাদের কাছে। পদ্মা নদী ছাড়া অন্য সব নদীতে সেতু হওয়ায় এখন ৮ থেকে সাড়ে ৮ ঘণ্টায় ঢাকা-কুয়াকাটা যাতায়াত করতে পারছি। পদ্মা সেতু চালু হলে এ সময় আরও অন্তত ৩ ঘণ্টা কমবে।
বরিশালের রেন্ট-এ-কার চালক আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘বরিশাল থেকে বাংলাবাজার হয়ে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১৭০ কিলোমিটার। বাংলাবাজার পৌঁছতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা। এরপর শিমুলিয়া থেকে বুড়িগঙ্গা সেতুতে পৌঁছানো যায় ৪০ মিনিটে। কেবল ফেরি চেপে পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে লেগে যায় ৩-৪ ঘণ্টা। সেতু চালু হলে মাত্র ৫ মিনিটেই পদ্মা পাড়ি দিতে পারব। সেক্ষেত্রে এখন যেখানে ঢাকা যেতে সময় লাগে ৭-৮ ঘণ্টা, সেখানে ৩ ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে যাব রাজধানীতে।
বরিশাল অঞ্চলের মতো খুলনা বিভাগের ১০ এবং ঢাকা বিভাগের ৫ জেলা থেকেও রাজধানী যেতে এখনকার তুলনায় ৩ ঘণ্টা সময় কম লাগবে বলে জানান এসব অঞ্চলের মানুষ। এমন অনেকে আছেন যারা পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আর থাকতে চান না ঢাকায়। শরীয়তপুরের বাসিন্দা ইমরুল সিকদার বলেন, ‘বাড়িতে চলে আসব। সকালে ঢাকায় গিয়ে অফিস করে আবার বিকালে ফিরব। এটা যে কত আনন্দের তা বলে বোঝাতে পারব না।
সড়কপথে যোগাযোগ প্রশ্নে বৈপ্লবিক পরিবর্তনই কেবল নয়, আরও কতভাবে যে দক্ষিণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু-তার খানিকটা বিবরণ দিলেন বরিশাল বিএম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ইমানুল হাকিম। তিনি বলেন, ‘এই একটি সেতু ২১ জেলার কয়েক কোটি মানুষের ভাগ্য কীভাবে বদলে দেবে তা আমরা এখন বুঝতে পারছি না। পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানীর সঙ্গে কম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন হলে গুরুত্ব বাড়বে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের। পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে নিজের অবস্থানকে আরও শক্ত করবে কুয়াকাটা। যোগাযোগে জটিলতার কারণে এতদিন উৎপাদিত কৃষিপণ্যের যথাযথ মূল্য পায়নি এ অঞ্চলের মানুষ। সেই অবস্থারও পরিবর্তন ঘটবে। যুগ যুগ ধরে আমরা দেখেছি রাজধানী ঢাকা ও এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে বহু শিল্প কলকারখানা হবে। এতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে, কমবে বেকারত্ব।
পদ্মা সেতু ঘিরে সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ ভাবনায়ও যে এখন কতটা আনন্দ তা বরিশালের গৌরনদীর বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিনের কণ্ঠে। চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে গিয়াস বলেন, ‘নদীর ওপারে উঠতে পারলেই ঢাকা, অথচ সেই নদী পার হতে ফেরির অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যে কতটা কষ্টের তা কেবল আমরাই জানি। এখন তো আর বসে থাকতে হবে না। ফুস করে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাব ঢাকা।
বরিশাল নগরীর বাসিন্দা এনজিও কর্মী রিয়াজউদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে কেবল বরিশাল এবং খুলনা বিভাগের সঙ্গেই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ছিল না রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের। বাধা হয়েছিল পদ্মা নদী। বরিশালে যাওয়ার কথা শুনলেই আঁতকে উঠত ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ। যেন বরিশাল-খুলনা সৌরজগতের বাইরে। অথচ দেখুন ঢাকা থেকে যেখানে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৩০০ এবং সিলেটের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার সেখানে বরিশাল মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে। কেবল এই নদীর কারণে যাতায়াত প্রশ্নে বরিশাল-খুলনা ছিল আতঙ্কের নাম। কিন্তু সেই আতঙ্ক জয় করতে যাচ্ছি আমরা।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘এই একটি সেতুর কারণেই বলতে গেলে যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে ছিল বরিশাল-খুলনা ও ঢাকা বিভাগের ২১ জেলার মানুষ। আমরা কৃতজ্ঞ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।