
সারাবিশ্বডটকম অনলাইন ডেস্ক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোয় দীর্ঘদিন দাবিহীনভাবে পড়ে থাকা লভ্যাংশ (ক্যাশ বা স্টক) ব্যবহারের লক্ষ্যে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ)’ বা ‘পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিল’-এর বোর্ড অব গভর্ন্যান্স গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ১০ সদস্যের এ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ তহবিল কীভাবে ব্যবহার করা হবে, বিনিয়োগকারীরা কতটুকু সুফল পাবেন, বাজারে কেমন প্রভাব পড়বে এবং এ তহবিল নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী হবে, সে বিষয়ে দৈনিক শেয়ার বিজের মুখোমুখি হয়েছেন নজিবুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার রহমত রহমান
শেয়ার বিজ: পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিলে কারা কীভাবে উপকৃত হবেন?
নজিবুররহমান: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা ফান্ড বা তহবিল গঠন সরকারের একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও সংস্কারমুখী উদ্যোগ। এ ফান্ড সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্ভাবনার যে নতুন জায়গা পুঁজিবাজার, এটাকে বিকশিত করার একটা পথ ও প্রয়াস। এছাড়া এ ফান্ড গঠনের মাধ্যমে বিএসইসি যে সংস্কারমনস্ক, তা প্রমাণিত হচ্ছে। এ ফান্ড পুঁজিবাজারের সবার জন্য সুফল বয়ে আনবে। এটাকে বলতে চাচ্ছি, উইন-উইন উদ্যোগ। এটি সরকার ও কমিশনের সংস্কার করার জন্য যে ইতিবাচক মনোভাব, তারই প্রমাণ দিচ্ছে। অর্থাৎ পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট সবাই এ তহবিলের দ্বারা উপকৃত হবেন। অন্যদিকে এ তহবিলের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা লাভবান ও সুরক্ষা পাবেন। একইভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিও বিভিন্ন সুফল পাবে। বিশেষ করে কোম্পানিগুলো এ তহবিলে জমা দেয়ার জন্য তাদের হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার করবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যেগুলো অবণ্টিত লভ্যাংশ নিয়ম অনুযায়ী এ তহবিলে জমা দেবেন। এতে যে তহবিল গড়ে উঠবে, তাতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এ তহবিল গঠন ও ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আইনে রূপ রেখা দেয়া আছে, যাতে বলা আছে, ৪০ শতাংশ শেয়ার কেনাবেচার কাজে ব্যবহƒত হবে, ৫০ শতাংশ মার্কেট মেকারদের মার্জিন ঋণ হিসেবে দেয়া হবে, ১০ শতাংশ সঞ্চয়ধর্মী খাতগুলোয় ব্যবহƒত হবে। এ তহবিলের মাধ্যমে সরকার ও কমিশন উপকৃত হবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো উপকৃত হচ্ছে। আর বিনিয়োগকারীরাও সুরক্ষা পাবেন। বিভিন্ন প্রয়োজনে মার্কেটে যে লিকুইডিটি ইনজেক্ট হবে, তাতে মার্কেটের যে গতি আছে, তা অব্যাহত থাকবে।
শেয়ার বিজ: এ তহবিল ব্যবস্থাপনায় বোর্ড কোন ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
নজিবুর রহমান: এ তহবিল ব্যবস্থাপনায় আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রথমত, এ তহবিল পরিচালনার জন্য একজন চিফ অব অপারেশন (সিওও) থাকবেন। তিনি এ তহবিলের সব কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এ মাসের মধ্যেই সিওও নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। তিনি যখন সিওও হিসেবে দায়িত্ব নেবেন, আমরা বোর্ড অব গভর্ন্যান্সে (বিওজি) যেসব সিদ্ধান্ত নেব, সেই সিদ্ধান্তগুলো তিনি বাস্তবায়ন করবেন। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও অভিজ্ঞ লোকজন নিয়োগ করবো। সেজন্য আমরা একটা হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেছি। এই স্ট্র্যাটেজির আওতায় বিনিয়োগ, ঋণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগকারীর প্রাপ্য পরিশোধসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিভাগীয় প্রধানদের অধীনে কয়েকজন ম্যানেজার ও বেশ কয়েকজন এক্সিকিউটিভ নিয়োগ করা হবে।
আমাদের ভিশন বড়। তবে আমরা প্রথমে ছোট আকারে শুরু করতে চাই। কাজের গতিশীলতা আনতে যতটুকু করা যায়, এখন ততটুকু জনবল নিয়োগ করা হবে। বর্তমানে বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের (বিওজি) অনুমোদন নিয়ে জরুরি নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডারদের সুবিধার্থে আমরা একটা ম্যানেজমেন্ট অফিস নেব। সবকিছু বিবেচনা করে দিলকুশা মতিঝিলের ডিসিসিআই ভবনে (চেম্বার ভবন) অফিস নেয়া হচ্ছে। মতিঝিল, দিলকুশা হচ্ছে পুঁজিবাজারের জন্য বাংলাদেশের ওয়াল স্ট্রিট। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডাররা উপকৃত হবেন। আমরা অল্প সম্পদ খরচ করে বেশি ইনপুট দিতে চাই। তৃতীয়ত, আমরা বিভিন্ন ধরনের পলিসি তৈরি করবো, যার মধ্যে রয়েছে ইনভেস্টমেন্ট পলিসি, লোন পলিসি, ম্যানেজমেন্ট পলিসি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পলিসি। জনবল নিয়োগ হয়ে গেলে পলিসি তৈরি করা হবে। চতুর্থত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেয়া। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আমরা একটা পার্টনারশিপ গড়ে তুলছি। পঞ্চমত, আমাদের বিভিন্ন লজিস্টিক ও ইক্যুইপমেন্ট লাগবে, যা আমরা সংগ্রহ বা প্রকিউর করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছি।
বোর্ডে আমরা সব সময় প্রচুর সময় দিচ্ছি। বছরে যেখানে ছয়টি সভা করার কথা, আমরা গত দেড় মাসে চারটি সভা করে ফেলেছি। কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা দিকনির্দেশনা দিচ্ছি। কাজগুলো একটা পর্যায়ে গেলে আমরা কবে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করব, তার একটা ঘোষণা দেয়া হবে। অর্থমন্ত্রী যাতে তার সুবিধামতো সময়ে এসে উদ্বোধন করতে পারেন। আমাদের সব কাজে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় এবং অন্যান্য কমিশনার ও কর্মকর্তারা খুবই সহযোগিতা করছেন।
শেয়ার বিজ: এ তহবিল এলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে কি না?
নজিবুর রহমান: এ তহবিল বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখবর। বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এই ধরনের একটি তহবিলের কথা চিন্তা করেছে, যেখানে প্রচুর পরিমাণ অব্যবহƒত সম্পদ বা স্টক তথা ডিভিডেন্ড রয়েছে, এটাকে সুন্দরভাবে ব্যবহারের জন্য এই তহবিল। এটাকে বলা হচ্ছে পারপেচুয়াল ফান্ড বা স্থায়ী তহবিল। এ তহবিল হবে বিনিয়োগকারীদের সম্পদের কাস্টোডিয়ান। বিনিয়োগকারী কেউ যদি বিদেশে বা দেশে থাকেন, অথবা কোনো মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী আসেন, তাদের চাওয়ামাত্রই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সম্পদ (স্টক বা ডিভিডেন্ড) পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এই তহবিল পেয়ে নিশ্চয়ই তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তা ব্যবহার করবেন। প্রথমত, যে তহবিলটার কোন হদিস ছিল না, এটাকে শনাক্ত করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে। এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। দ্বিতীয়ত, অনেকেই হয়তো বিভিন্নভাবে চেষ্টা বা চিন্তা করছিলেন যে আমার প্রাপ্য সম্পদ আমি কীভাবে পাব, সেই নিশ্চয়তা ছিল না। সিএমএসএফ তহবিল সেই নিশ্চয়তাটা দিচ্ছে, যে কোনো কোম্পানির কাছে আপনার যদি এমন অবণ্টিত ক্যাশ বা স্টক ডিভিডেন্ড থেকে থাকে, এটা ফেরত পাওয়ার একটা সহজ পদ্ধতি সরকার দিচ্ছে। অন্যদিকে তহবিলের ৪০ শতাংশ যখন শেয়ার কেনাবেচায় ব্যবহৃত হবে, সেখানেও বাজারে একটি ইতিবাচক ফল আসবে। কারণ এ তহবিল থেকে অত্যন্ত বাস্তব ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং গবেষণাধর্মী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এখানে একটি রিসার্চ উইং করা হচ্ছে, যেখানে পুঁজিবাজার নিয়ে গবেষণা হবে এবং কোথায় কোথায় লোন দেয়ার উপযুক্ত জায়গা সেগুলো চিহ্নিত করবে। এতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই বোর্ড অব গভর্ন্যান্স এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সব কি প্লেয়াররা এখানে রয়েছেন, যাদের অনেকে দেশের দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থাপনা এবং রেগুলেটরি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের সদস্যরা পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেখানে বাজারের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। অনেক সময় আমরা বাজার নিয়ে নেতিবাচক যে প্রচার-প্রচারণা দেখি, সেগুলোর অবসান ঘটবে। সেজন্য বিওজিতে একটা মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট থাকবে। এ ডিপার্টমেন্টের কাজ হবে গবেষণার যে ফল এবং এই তহবিলের গর্ভনিং বোর্ডের যেসব সিদ্ধান্ত আসবে, তা সঠিক সময়ে বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের কাছে পৌঁছানো। এতে বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ থাকবে না।
শেয়ার বিজ: ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আপনারা দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না?
নজিবুররহমান: আমরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কল্যাণে সব ধরনের উদ্যোগ নেব। প্রথমে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় তাদের সেবা দেয়া হবে, আমরা সেই পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে কাজ করছি। আমরা যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশে বসবাস করি, আমরা চাচ্ছি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যাতে অনলাইনে সহজে সব ধরনের সেবা নিতে পারেন। সেজন্য সময়োপযোগী ও কার্যকর একটা অপারেশন সফটওয়্যার তৈরি করা হচ্ছে। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে সফটওয়্যারটি তৈরি করা হচ্ছে।
আইনে বলে দেয়া আছে, যখন একজন বিনিয়োগকারী তার শেয়ার বা ডিভিডেন্ডের টাকা দাবি করবেন, ইস্যুকারী কোম্পানি বা কর্তৃপক্ষ তা ১৫ দিনের মধ্যে তাকে বুঝিয়ে দেবেন। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি দেখেন এই টাকা পেতে কোনো সমস্যা নেই, তাহলে তা বিওজি সুপারিশ করে দেবেন। বিওজি সেই সুপারিশ পরীক্ষা করে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করে বিনিয়োগকারীর দাবি করা স্টক বা টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমরা এমন একটি সিস্টেম ডেভেলপ করার চেষ্টা করছি, যাতে সহজে অনলাইনে বিনিয়োগকারী আবেদন করতে পারবেন। আবেদন ইস্যুকারী কোম্পানি পাওয়ার পরপরই, সেই আবেদনের ওপর কাজ করতে পারে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দরজায় দরজায় ঘুরতে না হয়, সেই ধরনের কাজ আমরা করব। সিস্টেমটি তৈরি হয়ে গেলে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচার করব। বিনিয়োগকারীদের জন্য ইউজার গাইড বা টিউটোরিয়াল তৈরি করা হবে, যা ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রকাশ করা হবে। আশা করি, এর সুফল বিনিয়োগকারীসহ সব পক্ষ পাবেন।
সূত্র: শেয়ার বিজ।