কোন টিভির বিক্রি বেশি, দেশি না বিদেশি?

সারাবিশ্বডটকম নিউজ ডেস্ক: মোবাইলের এই যুগ এখনও মানুষের কাছে আবেদন হারায়নি টেলিভিশন। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে টিভিও বদলেছে তার রূপ। একসময়ের বড় বাক্সের ক্যাথোড রে টিউবের (সিআরটি) টিভি আজ রূপ নিয়েছে স্লিম স্মার্ট টিভিতে। সবকিছুরও পরও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে টেলিভিশন। 

প্রযুক্তির পরিবর্তনের হাওয়া বর্তমানে বইছে আমাদের দেশেও। দেশেই এখন তৈরি হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির টিভি। আবার দেশের গন্ডি পেরিয়েও আমাদের দেশের তৈরি টিভি রফতানি হচ্ছে।

বর্তমানে দেশের বাজারে দেশি ব্র্যান্ডের টিভির চাহিদা তুলনামূলক হারে বাড়ছে। এক সময়ের বিদেশি ব্র্যান্ডের টিভির একচেটিয়া ব্যবসায়ে এখন দেশি ব্র্যান্ডের টিভিও তাদের নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। আগে প্যানাসনিক, ফিলিপস, ন্যাশনাল, সনি, স্যামসাং, এলজি, তোশিবা কিংবা টিসিএল এর মতো বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে ছিল দেশের টিভির বাজার।  কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। দেশের ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে৷ প্রতিদিনই নিজেদেরকে উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করে চলেছে দেশের টেলিভিশন তৈরির কোম্পানিগুলো। এখন বাংলাদেশে তৈরি টিভিগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়ালটন, মিনিস্টার, যমুনা, মাই ওয়ান, ভিসতা, ভিশন ও ট্রান্সটেক। এর মধ্যে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে দেশের তৈরি টিভি ও অন্যান্য পণ্য।

বিদেশি ব্র্যান্ডের টিভির ভিড়ে দেশি টিভিগুলো নিজেদের বাজার তৈরি করলেও প্রতিযোগিতা করছে একে অপরের সঙ্গে। দেশের বাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতেই তারা একে অপরের প্রতিযোগী। রাজধানীর বিভিন্ন টিভির শো-রুম সরেজমিনে ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে দেশি টিভির বাজার পরিস্থিতি। 

দেশি-বিদেশি নানা ব্র্যান্ডের টিভি ব্র্যান্ড পছন্দ করার পেছনে রয়েছে ক্রেতাদের সাধ ও সাধ্য এক করার হিসেব। দেশি বা বিদেশি- কোন ব্র্যান্ডের টিভি বেশি বিক্রি হচ্ছে তা জানতে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিদেশি টিভির ভিড়ে দেশি ব্র্যান্ডগুলো বাজারে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। সাধ্যের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি পেয়ে দেশি ব্র্যান্ডের টিভি বেছে নিচ্ছেন অনেক ক্রেতাই।

দেশি-বিদেশি টিভির মধ্যে কোন ব্র্যান্ডের টিভি ভালো তা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। দেশি ব্র্যান্ডের টিভিগুলো নিয়ে এই মতপার্থক্য একটু বেশি। আর বিদেশি ব্র্যান্ডের টিভির ক্ষেত্রে তা আটকে আছে দুই একটি ব্র্যান্ডের মধ্যে। দেশি-বিদেশি যে ব্র্যান্ডের টিভির মধ্যেই মতপার্থক্য থাকুক না কেন, এর পেছনে কিন্তু রয়েছে ক্রেতার অর্থনৈতিক অবস্থা। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সামঞ্জস্যতার কারণে বদলে যাচ্ছে তাদের টিভি কেনার ধরন। তবে ব্র্যান্ড বদলে গেলেও অখুশি নয় বিনোদনপ্রেমী ক্রেতারা। কারণ তারা তাদের সাধ্যের মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছে একাধিক ব্র্যান্ডের টিভি। 

মিরপুর ২ নম্বরে একটি শোরুমে টিভি কিনতে এসেছিলেন মাসুদ রানা। তিনি জানান তার বাজেট ২০ হাজার টাকা। এরমধ্যেই তাকে টিভি কিনতে হবে। কোনও পছন্দের ব্র্যান্ডের আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজেটতো কম। চাইলেও অনেক কিছু পারছি না। তবে ঠিক করে এসেছি ওয়ালটনের একটা টিভি কিনবো। এদের টিভি নাকি ভালো হয়, আমার এক আত্মীয় বলেছে।

রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের শিক্ষক ও গৃহিনী হাসান- ডলি দম্পতি। গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটে এসেছেন পরিবারের জন্য টিভি কিনতে। তাদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, বাসার জন্য একটা টিভি কিনবো। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরলাম কিন্তু এখনও কিনতে পারিনি। ওয়ালটন অথবা ট্রান্সটেক এই দুটো ব্র্যান্ডের মধ্যে কিনবো।

মিরপুর ১ নম্বরের মিনিস্টার টিভির বিক্রেতা ওবাইদুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে ওয়ালটন আর মিনিস্টার টিভির বাজার সবচেয়ে ভালো। এদের বিক্রি বেশি। আমাদের প্রতি মানুষের আস্থা বেশি তাই ক্রেতারা আমাদের টিভিই কেনে বেশি। তিনি আরও বলেন,আমাদের টিভি বেশি বিক্রি হয়, আর ওয়ালটনের ফ্রিজ আমাদের থেকে বেশি বিক্রি হয়।

মিনিস্টার টিভির মিরপুর ১ নম্বরের শাখার ইনচার্জ ফারুক হোসেন বলেন, আমাদের দেশি ব্র্যান্ডের টিভির মধ্যে মিনিস্টার আর ওয়ালটন টিভিই বেশি বিক্রি হয়। বিদেশি টিভি থেকে আমাদের দেশি টিভির ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি-ফ্যাসিলিটি বেশি থাকায় আমাদের টিভির বিক্রি বেশি হচ্ছে।

মিরপুর ১ নম্বরের বেস্ট ইলেকট্রনিকসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার রুহুল ইসলাম রুবেল বলেন, আমাদের শোরুমে আমরা দেশি টিভি রাখি না। তবে বিভিন্ন ধরনের ক্রেতা আমাদের এখানে আসেন। তাই তাদের চাহিদা বুঝি বা বাজারের অবস্থা দেখে বুঝি যে দেশি টিভির ক্ষেত্রে ওয়ালটন টিভির চাহিদা বেশি। আর বিদেশি টিভির মধ্যে সনি আর স্যামসাং টিভি বিক্রি বেশি হয়।

বেসরকারি চাকরিজীবী মাহফুজুর রহমান এসেছিলেন মিরপুর ১ নম্বরের স্যামস্যাংয়ের টিভি কিনতে। তার সঙ্গে কথা হলে বলেন, স্যামসাং বা সনি- এই দুটোর মধ্যে যেটা পছন্দ হয় সেটাই কিনবো। কেন দেশি ব্র্যান্ডের টিভি না কিনে বিদেশি ব্র্যান্ডের টিভি কিনতে চাইছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সনি, স্যামসাংয়ের একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে। এদের ওপর আস্থা রাখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশি টিভিগুলো সেভাবে এখনও আস্থা অর্জন করতে পারেনি। বিদেশি টিভির কোয়ালিটি অবশ্যই আমাদের দেশি টিভি থেকে ভালো এবং দীর্ঘদিন টেকে। 

সরকারি চাকরিজীবী রাতুল হাসান। তিনিও এসেছিলেন টিভি কিনতে মিরপুর ১০ নম্বরের ওয়ালটনের শোরুমে। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বাসার জন্য একটা টিভি কিনব। আমার বাজেট কম, তাই দেশি ব্র্যান্ডের টিভিই কিনব। আমি জানি দেশি টিভির থেকে বিদেশি টিভির মান ভালো। কিন্তু আমার বাজেট যেহেতু কম তাই আমাকে দেশি টিভিই কিনতে হবে। আমাদের দেশি টিভি যে খারাপ মানের তা কিন্তু না, হয়তো কোয়ালিটিতে ১৯/২০ হবে।

দেশি ও বিদেশি টিভির ক্রেতা কারা বা তাদের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রান্সকম ডিজিটালের মিরপুর ১ নম্বর শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক হোসাইন বলেন, যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তারা আসলে আমাদের দেশি ব্র্যান্ডের টিভিগুলো বেশি কিনছেন। ট্রান্সটেক বা এই ধরনের টিভিগুলো। আবার যাদের বাজেট নিয়ে ভাবতে হয় না তারা কিন্তু ব্র্যান্ডভ্যালুর কথা ভেবে স্যামসাং, সনির মতো টিভিগুলো কিনছেন। আর যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির তারা হায়ারের মতো ব্র্যান্ডের টিভি কিনছেন।

কীভাবে দেশি-বিদেশি টিভির মানের পার্থক্য করা হয় বা এদের দামের পার্থক্যই কেন- এমন বিষয়ে টিভি বিক্রেতারা জানান, ব্র্যান্ডভ্যালুর কথা। এছাড়া ছবির মানের কথাও বলেন তারা।

রাজধানীর গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেটের সনির শো-রুমের সেলস অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের কর্মী এনায়েত করিব বলেন, দেশি আর বিদেশি টিভির দামের পার্থক্য প্রায় অর্ধেক। ব্র্যান্ডভ্যালু এই দামের পার্থক্য তৈরি করেছে। এছাড়া দেশি টিভির থেকে বিদেশিগুলোর ইন্টারনাল ফাংশন বেশি। এগুলোর কালার কনজাম্পশন, রেজুলেশন, সাউন্ড কোয়ালিটিও উন্নত মানের; তাই এগুলোর দাম বেশি হয়ে থাকে।

একই প্রসঙ্গে ট্রান্সকম ডিজিটালের সহকারী ব্যবস্থাপক হোসাইন বলেন, দাম কম-বেশি হয় পার্টসের কারণে। ভেতরে যে পার্টসগুলো দেওয়া হয় সেগুলোর তো কোয়ালিটির একটা ব্যাপার থাকে। একই পার্টস কিন্তু তিন রকমের হয়। হায়ার, মিডিয়াম আর লোয়ার কোয়ালিটির।

বেশি বিদেশি টিভির মধ্যে কোন টিভি ভালো এমন প্রসঙ্গে এলে যথারীতি চলে আসে কোন টিভি বেশি আসে মেরামতের জন্য। এক্ষেত্রে বিক্রেতা এবং মেকারদের কাছ থেকে জানা যায়, যে টিভির বিক্রি বেশি সেই টিভি সারাইখানায় বেশি আসে।

বেস্ট ইলেকট্রনিকসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার রুহুল ইসলাম রুবেল বলেন, বিদেশি ব্র্যান্ডের মধ্যে সনি ব্র্যান্ডের টিভি বেশি আসে সার্ভিসিংয়ের জন্য। এক্ষেত্রে টিভির প্যানেলের সমস্যা নিয়েই বেশি আসেন ব্যবহারকারীরা।

মিরপুর ২ নম্বর এলাকার কমিটেড ইলেকট্রনিকের সার্ভিসিং কর্মী মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, আমার এখানে দেশি ব্র্যান্ডের মধ্যে ওয়ালটন আর বিদেশি ব্র্যান্ডের মধ্যে সনি টিভিই বেশি আসে ঠিক করাতে। আমি যতটুকু বুঝি যে টিভি বাজারে বেশি চলে সেটাই বেশি আসে সারাই করতে। সনি টিভি বেশি আসে প্যানেল নষ্টের সমস্যা নিয়ে। আর ওয়ালটন আসে অন্যান্য সমস্যা নিয়ে। ওয়ালটনের প্যানেল তেমন নষ্ট হয় না।

উল্লেখ্য রাজধানীতে কম্পিউটারের জন্য নির্দিষ্ট মার্কেট থাকলেও টিভি কেনার জন্য নির্দিষ্ট কোনও মার্কেট নেই। তবে টিভি কেনার জন্য বেশিরভাগ ক্রেতারাই গিয়ে থাকেন পছন্দের ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে। এছাড়া রাজধানীর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেট, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম মার্কেট কিংবা বায়তুল মোকাররম মার্কেটেও রয়েছে ক্রেতাদের কেনার বড় যায়গা।

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন